সামাজিক জরিপের সুবিধা ও অসুবিধা আলোচনা কর।
ভূমিকা: বর্তমান সময়ে সামাজিক জরিপ একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। সামাজিক জরিপের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের সমস্যাকে গঠনমূলক ও বর্ণনামূলক পদ্ধতি সম্পর্কে সহজে জানা যায়। এ সামাজিক জরিপের মাধ্যমে কোনো একটি এলাকা, সমষ্টি ও গোষ্ঠীর বিভিন্ন ধরনের তথ্য উদঘাটন করা সম্ভব হয়।
সামাজিক জরিপের সুবিধা
সামাজিক জরিপ একটি সুশৃঙ্খল ও তথ্যানুসন্ধান প্রক্রিয়া। সামাজিক জরিপের মাধ্যমে কোন এলাকায় জনগণের বিভিন্ন ধরনের ঘটনা, তাদের ধর্ম, সংস্কৃতি ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সামাজিক জরিপ শুধু জনসংখ্যার সাথে নয় এটির মাধ্যমে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সংস্কৃতি, জনমত ইত্যাদি বিষয়কে ভালোভাবে জানা যায়। সামাজিক জরিপের কিছু সুনির্দিষ্ট সুবিধা রয়েছে। এসব সুবিধা নিম্নে তুলে ধরা হলো।
১. নির্ভরযোগ্যতা: সামাজিক জরিপের মাধ্যমে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে কোন সমস্যা/ বিষয় সম্পর্কে সামাজিক জরিপ অধিকতর পারে এবং সে তথ্য বিভিন্ন ধরনের সমস্যা বিশ্লেষণে সহায়তা করে।
২. নীতি নির্ধারণ ও পরিকল্পনা প্রণয়ন: সামাজিক জরিপ অনেক সময় দেখা যায় যে সামাজিক গবেষণা করতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের নীতি নির্ধারণ ও পরিকল্পনা প্রণয়ন জাতীয় পর্যায়ে। বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি প্রণয়ন করে থাকে।
৩. পরিমাপযোগ্যতা: সামাজিক জরিপের মাধ্যমে পরিমাপযোগ্য তথ্য সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে সংখ্যাবাচক তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ অন্যান্য পদ্ধতি থেকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য। সংখ্যাত্মক তথ্য দিয়ে খুব সহজে সামাজিক জরিপ পরিমাপ করা যায়।
৪. নতুন জ্ঞান অর্জন: সামাজিক জরিপের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে নতুন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা যায়। নতুন কোন সমস্যা নিয়ে যখন কাজ করা হয় তখন ঐ বিষয়ে নতুন জ্ঞান অর্জন করতে এ জরিপ পদ্ধতি ভূমিকা পালন করে।
৫. কারণ জানা: সামাজ জীবনের নানা ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ ধরনের পরিবর্তনের কারণ কি এবং ভারসম্যহীনতার মাত্রা জরিপ সহায়ক সমাজ জীবনের নানা ধরনের পরিবর্তন
৬. ব্যাপক ক্ষেত্রে: সামাজিক জরিপ মূলত পরিচালিত হয় ব্যাপক আকারে। এটি যখন সমাজে পরিচালনা করা হয় তখন প্রায় গোটা সমাজ ব্যবস্থায় এর বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়।
৭. সাধারণীকরণ: সামাজিক জরিপ ব্যাপক বিস্তৃতভাবে পরিবেশিত হয়। এ থেকে সবধরনের তথ্য সংগ্রহ করা অনেক সময় খুব দুরূহ হয়ে পড়ে। এজন্য একটি সাধারণীকরণের ব্যবস্থা নেয়া হয়।
৮. দিক নির্দেশনা: সামাজিক জরিপ সমাজের বাঞ্ছিত উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য বিভিন্ন ধরনের নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে সামাজিক জরিপ বাস্তবায়নের জন্য সামাজিক জরিপ বিভিন্ন ধরনের দিক নির্দেশনা প্রদান করে থাকে।
৯. তুলনাকরণ: তুলনাকরণ সামাজিক জরিপে ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতির সাথে তুলনা করে নতুন কোন বিষয় পাওয়া যায় কিনা তা বোঝা যায়।
১০. অনুকল্প যাচাই: সামাজিক জরিপের মাধ্যমে কোন একটি তত্ত্ব যাচাই করার জন্য এ ধরনের কৌশল ব্যবহার করা হত। তবে সব ক্ষেত্রে অনুকল্প যাচাই গুরুত্বপূর্ণ নয়।
১১. তাৎপর্য উদঘাটন: তাৎপর্য উদঘাটন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কোন গবেষণার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টির কারণ কী তার ফলে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে এসব বিষয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
১২. নমুনা ভিত্তিক: সামাজিক জরিপের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ভুল ভ্রান্তি কমিয়ে আনা সম্ভব হয়। কারন, কেন গ্রহণযোগ্য তা নমুনার ভিত্তিতে করা সম্ভব হয়। তাই যে কোন ধরনের তথ্য যাচাইয়ের জন্য এটি সুবিধা দিয়ে থাকে। কম সময়ে কম শ্রমে ও কম অর্থ ব্যয় করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে থাকে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে সামাজিক জরিপ একটি জনবহুল তথ্য সংগ্রহের একটি পদ্ধতি হিসাবে পরিচিত লাভ করে। এর মাধ্যমে যে কোন ধরনের জরিপ করা হলে সে জরিপটির মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন ধরনের সমস্যার দিক অবস্থা প্রভাব ইত্যাদি বিষয় ফুটিয়ে তুলতে সহায়তা করে এই সামাজিক জরিপ।
সামাজিক জরিপের প্রকৃতি তুলে ধর।
ভূমিকা: সামাজিক জরিপ তথ্য অনুসন্ধানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল বলে বিবেচিত। এর মাধ্যমে অনেক সময় পর্যবেক্ষণ, প্রশ্নমালা, সাক্ষাৎকার ইত্যাদি একত্রিত প্রয়োগ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে করতে হয়। সাধারণত সামাজিক জরিপের কিছু প্রকৃতি বিদ্যমান।
সামাজিক জরিপের প্রকৃতি: সামাজিক জরিপের যেসব প্রকৃতি আছে তা নিচে তুলে ধরা হলো।
১. সামাজিক জরিপ এক ধরনের নকশা।
২. এর মাধ্যমে সরাসরি উত্তরদাতার কাছ থেকে তথ্য সংগৃহীত করা হয়।
৩. এর মাধ্যমে চলমান যেসব সমস্যা আছে তা নিতে বিভিন্ন ধরনের অধ্যয়ন করা হয়।
৪. এটি অনুসন্ধান পদ্ধতি হিসাবে সামাজিক গবেষণায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
৫. অনুমিত সিদ্ধান্ত প্রণয়ন ও তত্ত্ব উন্নয়নকল্পে ব্যবহৃত পরীক্ষামূলক নকশার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
৬. সামাজিক জরিপ সমাজের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ ঘটনা বর্ণনা ও বিশ্লেষণ করে থাকে।
৭. সামাজিক নমুনা ভিত্তিক হতে পারে আবার পূর্ণ গণনা ভিত্তিতেও হতে পারে।
৮. এটি নির্দিষ্ট সীমানায় নয় বরং বহুবিদ ক্ষেত্রে তথ্যানুসন্ধানকারী হিসাবে ব্যবহার হয়।
৯. সামাজিক জরিপের পরিধি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ।
১০. সামাজিক জরিপ একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং এতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার হয়ে থাকে।
১১. গঠনমূলক ও উন্নয়নমূলক সামাজিক কর্মসূচি পরিকল্পনার পূর্বশর্ত হিসাবে সামাজিক জরিপ কাজ করে।
১২. এটি বিশ্লেষণাধীন বিষয়ের একটি প্রতিনিধিত্বশীল অংশ অথবা সমগ্রক উভয়কেই অনুসন্ধান করে।
পরিশেষে বলা যায়, সামাজিক জরিপের উল্লিখিত এসব প্রকৃতি বর্ণনা করলে দেখা যায় সমাজের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র। সমাজের পূর্ণাঙ্গ চিত্র ফুটিয়ে তুলতে সামাজিক জরিপের এসব প্রকৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সামাজিক জরিপ পদ্ধতির অসুবিধা
বর্তমানে সামাজিক জরিপ পদ্ধতিটি একটি জনবহুল পদ্ধতি। এর মাধ্যমে সামাজিক জরিপ কাজ করা হলে তা জরিপের জন্য বেশি উপযোগী। তারপরও বহুল প্রচলিত হওয়া সত্ত্বেও এর কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। নিচে সামাজিক জরিপ পদ্ধতি সীমাবদ্ধতা তুলে ধরা হলো:
১. ক্ষণস্থায়ী: জরিপ পদ্ধতি দীর্ঘ সময় ধরে করা হয় না। কেননা, এটি প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। এটি দীর্ঘ সময় ধরে করলে কখনো ফলাফলে আসা যাবে না। যার ফলে ক্ষণস্থায়ীভাবে এটি জরিপ করা হয় বলে এর মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য খুব বেশি কার্যকরে আসে না।
২. নমুনায়নে সমস্যা: জরিপ কাজ করার জন্য নমুনা তৈরি করতে হবে। নমুনা নির্বাচন করতে হবে। সঠিকভাবে নমুনা নির্বাচন করতে না পারলে জরিপ কাজ সঠিকভাবে করা সম্ভব হয় না। নমুনার উপর নির্ভর করে তার জরিপ পদ্ধতির সাফল্য। কিন্তু আদি জনগোষ্ঠীর মধ্যে নানামুখী সমস্যা বিদ্যমান। এসব সমস্যার কারণে সঠিক নমুনা কষ্টকর হয় এবং সম্পাদিত নমুনা প্রায়শই প্রতিনিধিত্বশীল হয় না।
৩. উত্তরদাতার আবেগের অনুপস্থিতি: সামাজিক জরিপ পদ্ধতি তখনই সঠিকভাবে করা সম্ভব হবে যখন উত্তরদাতা সঠিকভাবে তথ্য প্রদান করবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে উত্তরদাতা সঠিকভাবে উত্তর দিতে চান না। তারা উত্তর দিতে অনেক সময় আবেগের বশবর্তী হয়ে উপস্থিত থাকেন না। উপস্থিত না থাকার পদ্ধতির যথাযথ প্রতিফলন হয় না। জন্য তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ যায় না। যার ফলে জরিপ নির্ধারিত লোক লাগে যিনি শুধু এ ধরনের কাজই করবেন।
৪. পক্ষপাতিত্ব: সামাজিক জরিপ পরিচালনা করার জন্য থাকার কারণে অনেক সময় ব্যক্তিগত মূল্যবোধ দ্বারা প্রভাবিত কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় যে একজন ব্যক্তি দীর্ঘ সময় লেগে সম্ভাবনা দেখা দেয়। আর যখনই এ ধরনের সম্ভাবনা দেখা দিবে তখনই জরিপ পদ্ধতির অসুবিধা হবে
৫. দরিদ্রতা: দারিদ্র্যতা সামাজিক জরিপ পদ্ধতির একটি ব্যয়বহুল খরচ। এর মাধ্যমে জরিপ কাজ চালাতে হলে খরচের পরিমাণ বা বাজেটের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। কিন্তু এটা সম্ভব নয়। যেমন: দরিদ্র ব্যক্তি সবসময় কিছু প্রাপ্তির আশায় থাকে। যখন তার আশা কমে আসে তখন উৎসাহ কমে যায়। যার ফলে সঠিকভাবে তথ্য শাওয়া যায় না।
৬. ভুল তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা: জরিপ পরিচালনা করার সময় সমাজের নানা ক্ষেত্রে এ জরিপ পদ্ধতি পরিচালনা করে থাকেন। যখন এ ধরনের জরিপ পদ্ধতি সমাজের মধ্যে পরিচালিত হয় তখন দেখা যায় যে সমাজের যাদের কাছ থেকে উত্তর বা তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে তাদের মধ্যে অনেক অবজ্ঞা, অপসংস্কৃতি, কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামী ইত্যাদি কারণে সঠিকভাবে জরিপ কাজ পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। যার ফলে জরিপ কাজের অসুবিধা হয়।
৭. অশিক্ষিত জনগণ: জরিপ পদ্ধতির সুবিধা হলো যারা এ সম্পর্কে জানেন তাদের কাছে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা। কিন্তু আমাদের দেশের জনগণ প্রায় অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষিত পাওয়া যায় না। যারা সঠিকভাবে বোঝেন না তাদের কাছে তেমন কোন তথ্য পাওয়া তো দূরের কথা তাদের জরিপ কাজ বোঝানোটাই দুরূহ হবে। তাই অশিক্ষিত জনগণ থাকার কারণে জরিপ কাজ সঠিকভাবে করা যায় না।
৮. ব্যয়বহুল পদ্ধতি: জরিপ কাজ মূলত একটি ব্যয়বহুল পদ্ধতি। এতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশ একটি হত দরিদ্র দেশ এদেশে জরিপ কাজ চালানোর মত সামর্থ্য নেই বললে চলে। উন্নত দেশে যেভাবে জরিপ কাজ চালানো যায় সেভাবে এখানে চালানো যায় না। তাই এটি এ দেশের মতো দেশে যথেষ্ট অসুবিধাজনক।
৯. নিয়ন্ত্রণহীনতা: সামাজিক জরিপ পদ্ধতি সাধারণত নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এটা আজ একরকম কাল আরেক রকম। এসবের কারণে সামাজিক জরিপ পরিচালনা করা অসুবিধাজনক।
১০. ব্যবস্থাপনা কঠিন: সামাজিক জরিপ পদ্ধতি ব্যবস্থাপনা খুবই কঠিন। এর মাধ্যমে জরিপ কাজ চালাতে হলে তা সঠিকভাবে করা সম্ভব হবে না। কারণ একে সঠিকভাবে দেখাশোনার মতো লোকবলের অভাব দেখা যায়। যার ফলে জরিপ পদ্ধতিতে অসুবিধা দেখা দেয়।
১১. অস্থায়ী: সামাজিক জরিপ একটি অস্থায়ী পদ্ধতি। এর মাধ্যমে কোন স্থায়ী রূপ পাওয়া যায় না। কারণ, এটি প্রতিনিয়ত রূপ পরিবর্তন করে। এখন যে জায়গায় ৯০% কাল সে স্থানে ৯২% হতে পারে। এভাবে প্রতিনিয়ত রূপ পরিবর্তন করে বলে এটি একটি অস্থায়ী পদ্ধতি। তাই এটিতে অসুবিধা দেখা দেয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, জরিপ পদ্ধতির যত সুবিধা অসুবিধা থাক না কেন এটি একটি জনবহুল পদ্ধতি। এর মাধ্যমে সমাজের একটি বাস্তব চিত্র, খুব অল্প সময়ে সামগ্রিক চিত্র পাওয়া যায়। এর বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও অতি প্রাচীনকাল থেকে এর অবদান দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।

No comments:
Post a Comment